ড. ইন্দ্রজিৎ সরকার
'বেদ' শব্দটি জ্ঞানার্থক বিদ্ ধাতু নিষ্পন্ন (বিদ্ + অচ্ বেদ) যার অর্থ জ্ঞান। জ্ঞান সধারণতঃ দুই প্রকার-পার্থিব ও অপার্থিব। প্রত্যক্ষ, অনুমান প্রভৃতির সাহায্যে যে জ্ঞান জন্মায় এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে জ্ঞান জন্মায় তাকে বলে পার্থিব জ্ঞান আর অতীন্দ্রিয় সূক্ষ্ম, যোগজ শক্তির দ্বারা যে জ্ঞান জন্মায় তাকে বলে অপার্থিব জ্ঞান। পার্থিব জ্ঞানের অপর নাম বিজ্ঞান আর অপার্থিব জ্ঞানের অপর নাম বেদ। বেদ হল অনাদি অনন্ত অলৌকিক জ্ঞানরাশি, যা সর্বদা বিদ্যমান। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং এরই সাহায্যে এই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কার্য করছেন। বেদ শব্দের মুখ্য অর্থ জ্ঞানরাশি আর গৌণ অর্থ শব্দরাশি। শব্দরাশিরূপ 'বেদ'ও আমাদের অসীম শ্রদ্ধার বস্তু কারণ এটি পরম পুরুষের বাত্ময়ী মূর্তি। এর অপর নাম শব্দব্রহ্মা 'বেদ অনাদি, অনন্ত বেদ, অপৌরুষেয়। ধর্মতত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্ব একমাত্র বেদ থেকেই জানা যায়। বেদ অখিল ধর্মের মূল। বেদের কয়েকটি প্রতিশব্দ হল শ্রুতি, ত্রয়ী, আগম, ছন্দস্, প্রভৃতি। বেদশ্রবণ বিধৃত ও স্মৃতিরক্ষিত হওয়ায় তার নাম শ্রুতি। ক্রিয়া অনুসারে বেদ তিনভাগে বিভক্ত বলে এর নাম ত্রয়ী। বেদ চারিটি-ঋক, সাম, যজুঃ অর্থব। প্রতিটি বেদের চারিটি বিভাগ-সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতায় আছে দেবতাদের স্তুতি, প্রার্থনা ইত্যাদি। এটি বেদের প্রধান অংশ। সাধারণভাবে বেদ বলতে আমরা এই সংহিতা অংশটিই বুঝি মীমাংসকদের মতে ইষ্টার্থক প্রচোদক বেদবাক্যই সংহিতা (মন্ত্রাংশ) যজ্ঞের অন্যতম পুরোহিত হোতা ঋকমন্ত্রের সাহায্যে দেবতাকে আহ্বান করেন। আর এক পুরোহিত উদ্দ্গাতা আহূত দেবতাকে সামগানের সাহায্যে স্তব স্তুতি করেন। আর এক পুরোহিত অধ্বর্য যজুমন্ত্র পাঠ করে আহূত দেবতার উদ্দেশ্যে অগ্নিতে আহুতি দেন। এভাবে একটি যজ্ঞের মধ্যে তিনটি বেদের মন্ত্র পাঠ করা হয়। ব্রহ্মণ শব্দ থেকে ব্রাহ্মণ শব্দ জাত। ব্রহ্মণ অর্থাৎ বেদ। বেদের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত বলে এর নাম ব্রাহ্মণ। অনেকে বলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের যজ্ঞ ও যজ্ঞের নানারকম ক্রিয়া সম্বন্ধে যে শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে, তাকে বলে ব্রাহ্মণ। যজ্ঞের সঙ্গে মন্ত্রের সম্পর্ক নির্দেশ করাই ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্যে। কোন যজ্ঞে, কোন সময়ে, কোন পুরোহিত, কোন মন্ত্র পাঠ করবেন তার নির্দেশ যে গ্রন্থে আছে তাকে বলে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের অপর নাম কর্মকাণ্ড (যজ্ঞকাণ্ড) প্রতি বেদের একাধিক ব্রাহ্মণ পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণের স্বাভাবিক পরিণতি আরণ্যক। ব্রাহ্মণের যজ্ঞবিদ্যা আরণ্যকে রহস্যবিদ্যায় পরিণত হয়েছে। ব্রাহ্মণের দ্রব্যযজ্ঞ আরণ্যকে জ্ঞানযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। আরণ্যক তাই একাধারে কর্মাশ্রয়ী এবং জ্ঞানাশ্রয়ী। অরণ্যে ব্রহ্মজিজ্ঞাসু শিষ্যকে গুরু রহস্যবিদ্যা দান করতেন। তাই এর নাম আরণ্যক। আরণ্যকে যে অধ্যাত্মবিদ্যার সূচনা, উপনিষদে তার পরাকাষ্ঠা। আরণ্যকের স্বাভাবিক পরিণতি উপনিষদ। দিক। গ্রন্থটির শিরোনাম 'উত্তিষ্ঠত জায়ত' প্রসঙ্গে দু-এটি কথা বলি। গ্রন্থটিতে ঈশ-কেন-কঠ-মুণ্ডক-মাণ্ডুক্য এই পাঁচটি উপনিষদের বাঙলা অনুবাদ ও মন্ত্রগুলির সহজ সরল সামান্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যাতে কোনোরকম মতবাদ বা গভীর তত্ত্ব আলোচনাও করা হয় নি। কেবল সাধারণ মানুষের মন্ত্রার্থ বুঝতে যেটুকু ব্যাখ্যার প্রয়োজন সেইটুকুই প্রদত্ত হয়েছে। 'উত্তিষ্ঠত জাগ্রত' কথাটি কঠোপনিষদের। প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় বল্লীর চৌদ্দ সংখ্যক মন্ত্রের প্রারজেই রয়েছে। শব্দ-যুগলের বাঙলা অর্থ অতি সাধারণ 'ওঠো জাগো'। স্বামীজী প্রবর্তিত মাসিক পত্রিকা 'উদ্বোধন' এর ধোয়বাক্য ছিল এই শব্দগুলি-'উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত'। স্বামীজি তাঁর ভাষণে বহু স্থানে উপনিষদের এই বচনটি উদ্ধৃত করতেন এবং তাঁর মনন ও চিন্তন অনুযায়ী একটি সুন্দর অনুবাদও করতেন-"Awake, rise and stop not till the goal is reached." স্বামীজি পরাধীন ভারতবাসীকে কঠোপনিষদের এই মন্ত্রের কশাঘাতে জাগাতে চেয়েছিলেন। এই ঔপনিষদিক বাণীকে স্বামীজি ঘুমন্ত ভারতবাসীর ঘুম ভাঙাবার জন্য প্রয়োগ করেছিলেন। স্বামীজি দেখিয়েছেন উপনিষদ আমাদের অভয় দান করে। আমরা যেন উপনিষদ থেকে অভয় মন্ত্র লাভ করে আপন জীবনে তাকে প্রয়োগ করে, উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারি। উপনিষদের মূল কথাটি হ'ল-'সেই পূর্ণত্বকে পরমকে লাভ করার।
জন্য নির্ভয়ে এগিয়ে চল।' স্বামীজির এই কথাটি বাঙালী তথা ভারতবাসীকে আবার মনে করিয়ে দেবার জন্য গ্রন্থের নাম রাখা হয়েছে 'উত্তিষ্ঠত জাগ্রত'। আজ সমস্ত ভারতবাসীর জেগে ওঠার দিন, নির্ভয়ে এগিয়ে চলার দিন এসেছে। গ্রন্থটি পাঠ করে পাঠক যদি নির্ভয়ে সেই পূর্ণত্বের দিকে, পরমের দিকে। এগিয়ে যেতে পারেন তবেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে। গ্রন্থটি প্রকাশের জন্যে তুহিনা প্রকাশনীর কর্ণধার এবং কর্মীদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
top of page
SKU: 9789348147172
₹250.00 Regular Price
₹200.00Sale Price
bottom of page